Friday, January 5, 2024

কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদ্গাহ ময়দান...

শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহ ময়দান। ১৮২৮ সাল থেকে এই মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ৭ একর আয়তনের শোলাকিয়া ঈদগাহ (Sholakia Eidgoan) মাঠে মোট ২৬৫ সারি আছে এবং প্রতি সারিতে প্রায় ছয়-সাতশ করে মুসল্লি দাঁড়াবার ব্যবস্থা আছে। সেই হিসেবে মাঠে এক লাখ ষাট থেকে আঁশি হাজার মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে প্রতিবছর ঈদুল ফিতরের সময় দেখা যায় মাঠে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় চারপাশের খোলা জায়গা, আশপাশের সড়ক, আশেপাশের ঘর বাড়ির উঠানেও নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। এভাবে প্রায় তিন লাখ মুসল্লি ঈদের নামাজ পড়ে থাকেন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে ও বিদেশ থেকে অনেক মুসুল্লির আগমনে এ মাঠের ঈদের জামাতের মর্যাদা অনেক বেড়ে গেছে। এমনকি বহু পর্যটক এই অভূতপূর্ব মহামিলনের সময়টি দেখার দেখার জন্যে শোলাকিয়ায় উপস্থিত হয়।

মাঠের ইতিহাস...
ইসলামের ঐশী বাণী প্রচারের জন্য সুদূর ইয়েমেন থেকে আগত শোলাকিয়া “সাহেব বাড়ির” পূর্বপুরুষ সুফি সৈয়দ আহমেদ তার নিজস্ব তালুকে ১৮২৮ সালে নরসুন্দা নদীর তীরে ঈদের জামাতের আয়োজন করেন।ওই জামাতে ইমামতি করেন সুফি সৈয়দ আহমেদ নিজেই। অনেকের মতে, মোনাজাতে তিনি মুসললিদের প্রাচুর্যতা প্রকাশে ‘সোয়া লাখ’ কথাটি ব্যবহার করেন। আরেক মতে, সেদিনের জামাতে ১ লাখ ২৫ হাজার (অর্থাৎ সোয়া লাখ) লোক জমায়েত হয়। ফলে এর নাম হয় “সোয়া লাখি”। পরবর্তীতে উচ্চারণের বিবর্তনে শোলাকিয়া নামটি চালু হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ বলেন, মোগল আমলে এখানে অবস্থিত পরগনার রাজস্বের পরিমাণ ছিল সোয়া লাখ টাকা। উচ্চারণের বিবর্তনে সোয়া লাখ থেকে সোয়ালাখিয়া সেখান থেকে শোলাকিয়া। পরবর্তিতে ১৯৫০ সালে স্থানীয় হয়বতনগর দেওয়ান পরিবারের অন্যতম দেওয়ান মান্নান দাদ খানের বদান্যতায় এ মাঠের কলেবর বৃদ্ধি পায় এবং এবং এর পরিধি বিস্তৃতি লাভ করে। দেওয়ান মান্নান দাদ খান ছিলেন বীর ঈশা খাঁর অধঃস্তন বংশধর।
সূত্র: ভ্রমণ গাইড

কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী পাগলা মসজিদ…


প্রাচীন ও আধুনিক স্থাপত্যের বিখ্যাত নানা দর্শনীয় স্থান রয়েছে কিশোরগঞ্জে। শহরের পশ্চিমে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক এই পাগলা মসজিদ। এর ইমরাত খুবই সুন্দর এবং নির্মাণশৈলীও বেশ চমৎকার। তিন তলা বিশিষ্ট পাগলা মসজিদের ছাদে তিনটি বড় গম্বুজ এবং ৫ তলা ভবনের সমান একটি মিনার বহুদূর থেকে সহজেই দৃষ্টি কাড়ে।

জনশ্রুতি আছে, কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক হয়বতনগর জমিদার বাড়ির ঈসা খানের বংশধর দেওয়ান জিলকদর খান ওরফে জিল কদর ‘পাগলা সাহেব’ নামক একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি নরসুন্দা নদীর তীরে বসে নামাজ পড়তেন। পরবর্তীতে স্থানটিতে মসজিদটি নির্মত হয়। জিল কদর পাগলার নামানুসারে মসজিদটি ‘পাগলা মসজিদ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। সূত্র: উইকিপেডিয়া

আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মসজিদটির বর্তমান জমির পরিমাণ ৩ একর ৮৮ শতাংশ। যা নির্মাণ কালে ছিল কেবল ১০ শতাংশ জমির ওপর।
পাগলা মসজিদটি শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীর কাছে নয়, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও এর আশেপাশের অঞ্চলে সব ধর্মাবলম্বীর কাছে অত্যন্ত পবিত্র ধর্মীয় স্থান হিসেবে পরিগণিত। এই মসজিদে মানত কিংবা দান খয়রাত করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়- এমন বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন বয়সী হিন্দু-মুসলিমসহ নানা ধর্ম-বর্ণের নারী-পুরুষ মানত নিয়ে এখানে আসেন। বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার এ মসজিদে মানত নিয়ে আসা বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের ঢল নামে। সাধারণ মানুষ এমন বিশ্বাসের আলোকে পাগলা মসজিদে প্রচুর দান-খয়রাত করে থাকেন। নগদ টাকা-পয়সা, স্বর্ণ ও রুপার অলংকারের পাশাপাশি গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি দান করেন। অধিক দান-খয়রাতের কারণে পাগলা মসজিদ ইতিমধ্যেই দেশের অন্যতম আয়কারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। জানা যায়, সাধারণত প্রতি চারমাস পরপর মসজিদের দানবাক্স খোলা হয়। প্রতিবার দানবাক্স খোলার পর কোটি টাকা পাওয়া যায়। এ ছাড়াও আরো পাওয়া যায় ডলার, ইউরো, সৌদি রিয়েল, ইয়েন, দিনারসহ ইত্যাদি বিদেশি মুদ্রা। এমনকি বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণালংকার পাওয়া গেছে দান বাক্স থেকে।

২০২৩ সালের ৬ই মে পাগলা মসজিদের আটটি দানবাক্স খোলা হয়। এতে রেকর্ড ৫ কোটি ৫৯ লাখ ৭ হাজার ৬৮৯ টাকা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া একটি ডায়মন্ডের নাকফুলসহ বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া গেছে। এর আগে ৭ই জানুয়ারি দানবাক্স খোলা হয়েছিল। ২০টি বস্তায় তখন ৪ কোটি ১৮ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৪ টাকা এবং বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া গিয়েছিল। সাধারণত ৩/৪ মাস পর মসজিদের দানবাক্স খোলা হয় এতে গড়ে প্রায় ৪ কোটি ওপরে টাকা পাওয়া যায়। 

মসজিদ পরিচালনা কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদে আন্তর্জাতিক মানের দৃষ্টিনন্দন ইসলামিক কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দ্রুতই এর কাজ শুরু করা হবে। এটি নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। যা বাস্তবায়ন হলে ৫০ সহস্রাধিক মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন। 
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক

Friday, December 29, 2023

নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা সাগরকন্যা কুয়াকাটা...


সৌন্দর্যে সমাবেষ্টিত সাগরকন্যা কুয়াকাটা, যেখানে একই সাথে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্যে  অবলোকন করা যায়। কুয়াকাটা পৌরসভা, পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর থানায় অবস্থিত। ঢাকা থেকে প্রায় ৩০০শ কিলোমিটার দক্ষিনে অবস্থিত। এটি বরিশাল শহর থেকে প্রায় ১১০ কিলোমিটার দক্ষিণ এবং পটুয়াখালী শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। ঢাকা থেকে বাসে বা গাড়িতে করে পদ্মা সেতু হয়ে বরিশাল শহরের ভেতর দিয়ে সরাসরি কুয়াকাটায় যাওয়া যায় এবং রাস্তা বেশ ভালো আর ভাঙ্গা অংশগুলো মেরামত করা হয়েছে। 

কুয়াকাটায় বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নতুন আবিষ্কৃত চর বিজয় যা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত হতে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিনে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে অবস্থিত। প্রায় আড়াই বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই চরটি লাল কাঁকড়ার চর নামে পরিচিত। এখানে অনেক পাখিও দেখতে পাওয়া যায়। এখানে স্পিডবোট বা ট্রলারের মাধ্যমে আসতে হবে, স্পিডবোট দিয়ে যেতে আসতে প্রায় এক ঘন্টার মত সময় লাগবে। 

কুয়াকাটার পশ্চিম প্রান্তে তিন নদীর মাথা বা মোহনা, সুন্দরবনের পূর্বংশ এবং এটি ফাতরার চর নামে পরিচিত, ঝাউবন, ঝিনুক চর, ম্যানগ্রোভ বন, লেবুর বন এবং শুটকি পল্লী অবস্থিত। লেবুর বন ও শুটকি পল্লী পাশাপাশি অবস্থিত এবং এখান থেকেই সুন্দর ভাবে সূর্যাস্ত দেখা যায়। এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখার পাশাপাশি মাছ ভাজা খেতে পারেন, তবে দাম তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। লেবুর বনে টিনের তৈরী একটি মসজিদ রয়েছে। 

পূর্বপ্রান্তে গঙ্গামতি সৈকত, গঙ্গামতি লেক এবং ম্যানগ্রোভ বন অবস্থিত। ম্যানগ্রোভ বনটি ২০০৭ সালে সিডরের কারণে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় এবং ধ্বংসাবশেষ সারি সারি বৃক্ষগুলো  ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে এখনো বিদ্যমান।  গঙ্গামতি সৈকত থেকে সুন্দরভাবে সূর্যোদয় অবলোকন করা যায়। সূর্যোদয় দেখতে হলে আপনাকে সূর্যোদয়ের প্রায় একঘন্টা আগে রওনা দিতে হবে। কুয়াকাটা চৌরাস্তা থেকে গঙ্গামতি সৈকতের দূরত্ব প্রায় সাড়ে আট কিলোমিটার এবং রাস্তা বেশ খারাপ। ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা দিয়ে যেতে হবে। আপনারা চাইলে গঙ্গামতি লেক পার হয়ে কাউয়ার চর প্রথম মাথায় যেতে পারেন। এখানেও লাল কাঁকড়া দেখতে পারবেন, তবে চর বিজয়ের চেয়ে অনেক কম।

সূর্যোদয় দেখে ফেরার পথে আপনারা ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার মাধ্যমে মিশ্রি পাড়ায় রাখাইন পল্লীতে যেতে পারেন। মিশ্রি পাড়ায় রাখাইনদের তাঁত পল্লী, কুয়াকাটায় রাখাইনদের ইতিহাস সম্বলিত একটি জাদুঘর, গৌতম বুদ্ধের ৬০ ফিট মূর্তি অবস্থিত। 

কুয়াকাটার চৌরাস্তার পাশেই প্রায় ৩৫ মণ ওজনের গৌতম বুদ্ধের একটি মূর্তি রয়েছে যা স্বর্ণ এবং পিতল দিয়ে ১৯২৪ সালে তৈরি করা হয়েছিল। বৌদ্ধ মন্দিরের প্রবেশপথে বাঁদিকে একটি পানির কুয়া কাটা হয়েছিল যার নাম কাটা মাথার কুয়া এবং এই কুয়ার নাম অনুসারে এই অঞ্চলের নাম কুয়াকাটা। বৌদ্ধ মন্দিরের পাশে পুরনো একটি নৌকা রয়েছে, এটি ৫০টি নৌকার মধ্যে মধ্যে একটি নৌকা যেগুলো দিয়ে প্রায় ১২০ টি রাখাইন পরিবার বার্মিজ সৈন্যদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ১৭৭৪ সালে আরকান রাজ্য থেকে সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে এ অঞ্চল এসেছিল। 

কুয়াকাটা ভ্রমণকালে আমাদেরকে বেশ কিছু অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল...
১. এখানে আবাসন বা হোটেল ভাড়া অস্বাভাবিকভাবে বেশি এবং আপনাকে ভালোভাবে জেনে শুনে ও দর কষাকষি করে আবাসন বা হোটেল ঠিক করতে হবে। অন্যথায় আপনি আর্থিকভাবে ভালই ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। 
২. মূল্যের তুলনায় হোটেলের পরিবেশ এবং সুবিধাদি বেশ অপ্রতুল। 
৩. উন্নত মানের খাবার-দাবার ব্যবস্থাও বেশ অপ্রতুল এবং মূল্য আকাশচুম্বী। ওখানকার কোন খাবারেই আমাদের ভালো লাগেনি এবং সুস্বাদুও ছিলনা।
৪. সমুদ্র সৈকত বা অন্যান্য দর্শনীয় স্থানে ফটোগ্রাফারদের ব্যাপারে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করবেন, কেননা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আপনাকে ফাঁদে বা বেশ বেকায়দায় ফেলতে পারে। এদের সাথে ভালোভাবে কথা বলে ছবি তোলার ব্যবস্থা করবেন, অন্যথায় আপনার কাছ থেকে অনেক অর্থ হাতিয়ে নিতে পারে। 
৫. স্পিডবোট বা ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার ভাড়াও বেশ চড়া। ভালোভাবে দরদাম কষে ভাড়া ঠিক করবেন। 

কুয়াকাটা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত, কিন্তু পর্যটকদের বিভিন্ন ধরনের সুবিধাদি বেশ অপ্রতুল। যদিও প্রশাসন বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ শুরু করেছেন। আশা করি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কুয়াকাটা অনন্য একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।